বিশ্বের যতো আশ্চর্য স্থাপনা আছে তার সিংহভাগই বলা চলে দুবাইয়ে অবস্থিত। এই শহরে বিশাল অট্টালিকা ও আলো ঝলমলে পরিবেশে যেমন সময় কাটাতে পারবেন ঠিক তেমনই হারিয়ে যেতে পারবেন প্রাকৃতিক স্বর্গে। বলছিলাম দুবাই মিরাকল গার্ডেন এর কথা। এমন স্বর্গীয় পরিবেশ পৃথিবীতে আর দু’টো নেই। এটি মূলত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুলের বাগান। কেন বলছি মিরাকল গার্ডেন পৃথিবীর বড় ফুলের বাগান? কারণ ২০১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মিরাকল গার্ডেন এর যাত্রা শুরু হয় আর ঐ বছরই এটি বিশ্বের সবথেকে বড় ফুলের বাগান হিসেবে গিনেস বুকে এর নাম ওঠে। পুরো পার্কটি এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য নিয়ে ৭২ হাজার বর্গমিটার জায়গা জুড়ে বিদ্যমান। মিরাকল গার্ডেন ভ্রমনের জন্য আপনাকে চলে যেতে হবে দুবাই এর এর শেখ মুহাম্মদ বিন জায়েদ সড়কে৷ এই সড়কের ঠিক পাশেই মিরাকল গার্ডেন এর অবস্থান।
মিরাকল গার্ডেন কেন বিখ্যাত?
মরুভূমির উত্তপ্ত বালুতে ছোট ছোট আগাছা জন্মালেও তা বেশিদিন টিকতে পারে না। গাছপালা তো খুবই কম। আর সেই মরুভূমির বুকে লক্ষ লক্ষ রং বেরঙের ফুল দিনের পর দিন ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব বৈ আর কিছুই না। কিন্তু এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছে দুবাই সরকার। মরুভূমির বুকেই নির্মাণ করেছে পৃথিবীর সবথেকে বড় ফুলের সংগ্রহ। শুধু কি সাধারন ফুলের বাগান এটি? উঁহু, একদমই না! এই বাগানে ফুল গাছ ও লতাপাতা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সুবৃহৎ সব ভাষ্কর্য ও কার্টুন চরিত্র। গাছ ও তাজা ফুল দিয়ে যে এতো এতো সুবৃহৎ ভাষ্কর্য তৈরি করা যায় তা হয়তো কেউ আগে কখনও ভাবতেও পারেনি। পৃথিবীর বুকে এক স্বর্গরাজ্য হিসেবে মিরাকল গার্ডেন দৃষ্টি কেড়েছে পৃথিবীর প্রায় সকল সৌন্দর্য পিপাসুদের। তাইতো বিশ্ব দরবারে মিরাকল গার্ডেন এর এতো বেশি কদর।
মিরাকল গার্ডেনে কী কী উপভোগ করবেন?
মিরাকল গার্ডেনে প্রবেশ করার পরেই হয়তো আপনার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাবে। কেননা আপনি পার্কের প্রথম গেইট থেকে হাঁটা শুরু করে পুরো গোলাকৃতির পার্কটি চক্কর দিতে দিতে হতবাক হয়ে যাবেন৷ কী আশ্চর্য বুদ্ধিমত্তা ও পরিকল্পনার ফল এই মিরাকল গার্ডেন, ভেবে ভেবে তার কোনো কূল কিনারা পাবেন না। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই হাজারো ফুলের মেলায় নিজেকে হারিয়ে ফেলবে। পুরো পার্কটি জুড়েই আছে চোখ ধাঁধানো সব আয়োজন। কোনটা রেখে কোনটা দেখবেন তা ভেবে পাবেন না। তবে এখানে মিরাকল গার্ডেন এর উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো।
১. বিশাল আকৃতির গাছ লতাপাতার ভাষ্কর্য
মিরাকল গার্ডেন এর প্রথম গেইট দিয়ে প্রবেশ করলেই প্রথমে আপনি অবাক হবেন জীবন্ত ঘাসের তৈরি প্রাণীর ভাষ্কর্য দেখে। কোথাও জিরাফ, কোথাও হাতি, কোথাওবা ঘোড়া, মানুষ, মিকি মাউস, ডিজনি ওয়ার্ল্ড এর সকল সদস্য সহ অনেক অনেক ভাষ্কর্য আপনার চোখে পড়বে। গাছপালা আর ফুল দিয়ে যে এতো চমৎকার সব ভাষ্কর্য বা প্রাণীর অবয়ব তৈরি করা যায় এটা আপনি নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না। তবে সবার প্রথমে চোখ আটকে যাবে শূন্যে ভেসে থাকা এক বালিকার ভাষ্কর্যে। এই ভাষ্কর্যে বালিকার পোশাক ও চুল তৈরি করা হয়েছে জীবন্ত ফুলের গাছ দিয়ে। আর পুরো শরীরটা যেন বাতাসে ভেসে আছে। দেখলে চোখ কপালে উঠে যাওয়ার মতো অবস্থা। তবে মিরাকল গার্ডেন এর বেশিরভাগ ভাষ্কর্য-ই প্রতি বছর বছর পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ এই বছর আপনি যে সকল থিম এর ভাষ্কর্য দেখবেন পরের বছর ঠিক একই ভাষ্কর্য আপনি নাও দেখতে পারেন। কেননা এর পরিবর্তে তৈরি করা হবে অন্য কোনো অবয়ব। এভাবেই প্রতি বছর বছর নানন ভঙ্গিতে পর্যটকদের বিস্মিত করে মিরাকল গার্ডেন।
২. ফুলের ঘড়ি
বিশ্বের সবথেকে বড় ও সুন্দর ফুলের ঘড়ি হিসেবে গিনেস বুকে নাম উঠেছে মিরাকল গার্ডেনে অবস্থিত ফুলের ঘড়ির। পুরো ঘড়ির ভেতরের মেশিনারিজ ও দুটো কাটা বাদে সবকিছুই ডেকোরেশন করা হয়েছে রং বেরঙের ফুল ব্যবহার করে। ১৫ মিটার ব্যাস বিশিষ্ট এই ঘড়িটি দেখে অবাক না হয়ে আপনি পারবেন না। মিরাকল গার্ডেন এর একটি উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ এই ফুলের ঘড়ি। এমন অদ্ভুত ঘড়ি সম্পর্কে হয়তো এর আগে কেউ কখনও ভাবতেও পারেনি। আর এই অবাস্তব বিস্ময়কে বাস্তব করে তুলছে মিরাকল গার্ডেন কর্তৃপক্ষ।
৩. ফুলের তৈরি এয়ারক্রাফট
২০১৬ সালে দুবাই মিরাকল গার্ডেন এর আরও একটি শিল্প বা ভাষ্কর্য গিনেস বুকে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। সেটি হলো ফুলের তৈরি এয়ারক্রাফট। Fly Emirates এর এয়ারক্রাফট এর অবয়বে তৈরি করা এই ভাষ্কর্যটিকে হঠাৎ করে দেখলে যে কেউ আসল Emirates বিমান বলে ভুল করতে পারে। কোনো অংশেই একে পেছনে ফেলা সম্ভব নয়। তাইতো বিশ্ব পর্যটকদের নজরে বার বার চলে আসে দুবাই মিরাকল গার্ডেন এর কৃত্রিম এই এয়ারক্রাফট। এই বিমানটি সরাসরি তাজা ফুলের গাছকে ধারাবাহিক ভাবে সাজিয়ে ডেকোরেশন করা হয়েছে এবং রঙের প্যাটার্ন এর মাধ্যমে বাস্তব ভিত্তিক কায়দায় Emirates কথাটি লেখা হয়েছে। সব মিলিয়ে সত্যিই উপভোগ্য একটি বিষয়।
৪. আমব্রেলা প্যাসেজ
মিরাকল গার্ডেন এর এই অংশটুকু ডেকোরেশন করা হয়েছে ছাতা দিয়ে। উপরের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন শতশত ছাতা একত্রিত হয়ে ছায়া দিচ্ছে। আর নিচে আছে বসার জন্য চেয়ার টেবিল এর সুব্যবস্থা। এখানে বসে ফটোসেশান এর একটা চমৎকার আয়োজন করে নিতে পারেন। রৌদ্রজ্বল দিনে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গেলে আমব্রেলা প্যাসেজ হবে আপনার বিশ্রামের উপযুক্ত জায়গা।
৫. লাভ জোন
খুব রোমান্টিক একটা ফিল পাবেন এই লাভ জোন এর মধ্যে দিয়ে হেটে যাওয়ার সময়। একটি লেন এর পুরোটা আবৃত করা হয়েছে ফুলের তৈরি লাভ দিয়ে। অর্থাৎ রাস্তার দুপাশ আর ওপরের অংশ ছেয়ে আছে রং বেরঙের ফুলের লাভ শেইপে। যরা ফটো তুলতে ভালোবাসেন তাদের কাছে এই লাভ জোন খুবই পছন্দ হবে বলে আশা করা যায়।
৬. অন্যান্য ডেকোরেশন
ফুলের বাগান, প্রাকৃতিক ভাষ্কর্য ছাড়াও এখানে আরও আছে লেক, গাছ ও ফুলের তৈরি ভিলা, ফোয়ারা, খোলা মাঠ, চমৎকার লেন ও দোলনা। মূলত মিরাকল গার্ডেন এর প্রতিটি আনাচে কানাচে দেখার মতো ডেকোরেশন করা হয়েছে। আর পার্কের মধ্যে আছে একটি অবজারভেশন ডেক। এখান থেকে পাখির চোখে পুরো পার্কটিকে দেখতে পারবেন৷ মনে হবে আপনি কোনো ফুলের সমুদ্রের মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছেন। এটাকে তো সত্যিই এক মিরাকল বলা চলে!
মিরাকল গার্ডেন এর আসল মিরাকল যে কতোটা আশ্চর্যমন্ডিত তা আসলে নিজ চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবেন না।
কখন যাবেন মিরাকল গার্ডেন ভ্রমনে?
শুষ্ক মরুভূমি এলাকায় মিরাকল গার্ডেন এর অবস্থান হওয়ায় সারা বছর এটি খোলা থাকে না। বছরের ছয় মাস অর্থাৎ নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত মিরাকল গার্ডেন জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বাকি ছয় মাস প্রচন্ড গরমের কারনে এটি বন্ধ থাকে। এই বন্ধের ছয় মাসে বাগানের পরিচর্যা করা হয় এবং পুরো পার্কের থিম বদলে নতুন করে এটি ডেকোরেশন করা হয়। তাই মিরাকল গার্ডেন ভ্রমনের উদ্যেশ্যে দুবাই গেলে আপনাকে অবশ্যই নভেম্বর থেকে এপ্রিল এর মধ্যে ট্রিপ প্লান করতে হবে। আর সকালের দিকে কখনোই মিরাকল গার্ডেন ভ্রমনের যাবেন না। এই সময়টাতে প্রচন্ড রোদের তাপ থাকে। দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মিরাকল গার্ডেন এর আসল রূপ ও সৌন্দর্য ধরা পরে। আর রাতের পরিবেশটা একদমই আলাদা। প্রতিটি কোনায় কোনায় জ্বলে ওঠে রঙিন আলোর ঝলকানি। তাই দুপুরে ঘোরাফেরা শুরু করে রাত পর্যন্ত গার্ডেনের ভেতরে সময় কাটাতে পারেন।
শেষকথা
আশাকরি এবার দুবাই ভ্রমনে গেলে প্রথম প্লান থাকবে মিরাকল গার্ডেন ঘুরে দেখা। শহরের যে কোনো প্রান্ত থেকে মেট্রোরেল, বাস, ট্যাক্সি কিংবা প্রাইভেট কারে চেপে মিরাকল গার্ডেন এর প্রবেশ গেইটে চলে যেতে পারবেন। তবে একটু সাশ্রয়ী উপায় খুঁজলে মেট্রোরেল এবং বাস-ই উপযুক্ত। আর সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে না থাকে যাওয়ার সাথে সাথে পার্কে প্রবেশ করতে চাইলে আগে থেকেই অনলাইনে টিকেট সংগ্রহ করে রাখতে ভুলবেন না। একটি অসাধারণ ভ্রমণ অভিজ্ঞতার জন্য অগ্রিম শুভেচ্ছা রইলো। ধন্যবাদ।