আলো ঝলমলে সুউচ্চ অট্টালিকার শহর দুবাই। অনেকেইরই এটা ভেবে ভ্রম হয় যে দুবাই বুঝি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ। তবে এটা মনে রাখবেন দুবাই হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত এর একটি অত্যাধুনিক শহর, কোনো দেশ নয়। সংযুক্ত আরব আমিরাত এর অন্যতম পর্যটন শহর বললেও ভুল হবে না দুবাইকে। এই শহরে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের লোকজনই বসবাস করে। তাছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকের আনাগোনা তো প্রতিনিয়ত শহরটিকে সরগরম করে রাখে। এই শহরের সুউচ্চ আধুনিক স্থাপত্যশৈলী যেমন আপনাকে অবাক করবে তেমনই এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে শিহরিত হবেন বারবার। দুবাই এর প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পারবেন ডেজার্ট সাফারি ভ্রমণ এর মাধ্যমে। তাছাড়া আরবীয় ঐতিহ্য ও বিখ্যাত বেদুইন সংস্কৃতিতে বুদ হয়ে যেতে পারবেন একটা দিনের জন্য। মরুভূমির বুকে ঘুরে বেড়ানো, আরবীয় খাদ্যাভ্যাস, আরবীয় সংস্কৃতি আপনার ভ্রমনে পরিপূর্ণতা নিয়ে আসবে। ডেজার্ট সাফারি ভ্রমনের মাধ্যমে আপনি আরবীয় সভ্যতা ও আরবের প্রকৃতিকে এক নতুন আঙ্গিকে উপলব্ধি করতে পারবেন।
চলুন দুবাই এর ডেজার্ট সাফারি থেকে ঘুরে আসি কিছু সময়ের জন্য।
ডেজার্ট সাফারি ভ্রমন প্লান
বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলোতে ঘুরতে যাওয়ার আগে অবশ্যই একটি সুপরিকল্পিত ট্যুর প্লান করে নেয়া জরুরি। কেননা এটা বাংলাদেশর অভ্যন্তরীন কোনো ট্যুরিস্ট স্পট না, যে বললাম আর যখন খুশি বেড়িয়ে পড়লাম। প্রথমেই আপনার বিদেশে ভ্রমনের জন্য পাসপোর্ট তৈরি করতে হবে। পাসপোর্ট এর প্রসেসিং শেষ হলে ভিসার জন্য ট্রাই করতে হবে। দুবাই ভ্রমণ বেশ খরচ সাপেক্ষ এটা তো আমরা সকলেই কমবেশি জানি। তাই ফিন্যান্সিয়াল প্রিপারেশন সবার আগে নিতে হবে।
বাংলাদেশ থেকে অনেক ট্রাভেল এজেন্সি ট্যুরিস্ট ভিসার ব্যবস্থা করে দেয়। তাই নির্ভরযোগ্য যে কোনো ট্রাভেল এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করে ভিসা সংগ্রহ করে নিতে হবে। সেই সাথে আপ ডাউন টিকেট সংগ্রহ ও দুবাই পৌঁছে থাকার জন্য হোটেল বুকিং সব কিছুই আপনাকে আগে থেকে গুছিয়ে রাখতে হবে। এই অফিসিয়াল ও নন অফিসিয়াল যাবতীয় সকল প্রসেস ট্রাভেল এজেন্সির ওপর ছেড়ে দিতে পারবেন।
অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে দুবাই শহরে পৌঁছানো পর্যন্ত সকল ব্যবস্থা ও দুবাইয়ে থাকার জায়গার ব্যবস্থা আপনাকে বাংলাদেশ থেকেই গুছিয়ে নিতে হবে। এরপর দুবাই পৌঁছে ডেজার্ট সাফারি ভ্রমনের যাবতীয় প্লান করতে পারবেন। দুবাই শহর থেকে ডেজার্ট সাফারি বা দুবাই এর মূল মরুভূমির দূরত্ব মাত্র ৩৫ কিলোমিটার। কিন্তু মূল এডভেঞ্চার শুরু করার জন্য সড়কপথে আপনাকে ৫১.৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে।
দুবাই থেকে বাস, ট্যাক্সি, কিংবা জিপে করে ডেজার্ট সাফারির স্টার্টিং পয়েন্টে পৌঁছাতে পারবেন। এরপর ট্যুর গাইড সহ জীপ ভাড়া করে মরুভূমির মূল ভ্রমণ শুরু করতে পারবেন।
তবে সবথেকে ভালো হয় অনলাইন বা অফলাইনে ডেজার্ট সাফারি ভ্রমনের জন্য একটি ট্যুর প্যাকেজ বুক করলে। আপনি যে হোটেলে উঠবেন সেখান থেকেও ট্যুর প্যাকেজ এর ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। চাইলে স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্সি বা ট্যুর গাইড এর অফিস থেকে সরাসরি প্যাকেজ বুক করতে পারবেন। ট্যুর প্যাকেজ বুক করলে সরাসরি আপনার হোটেল থেকে আপনাকে পিক করা হবে এবং ভ্রমণ শেষে আবার আপনাকে হোটেলে নামিয়ে দেয়া হবে। পুরো ট্যুর প্যাকেজ এর অন্তর্ভুক্ত থাকবে খাওয়া দাওয়া, বিনোদন সহ ডেজার্ট সাফারির মূল আকর্ষণ এর প্রায় সব কিছুই। তাই আপনি আপনার সুবিধা মতো যে কোনো একটি প্যাকেজ বুক করে নিতে পারেন অথবা ব্যক্তিগত ভাবে ভ্রমণ করতে পারেন।
ডেজার্ট সাফারি ভ্রমনের মূল আকর্ষণ সমূহ
আরব দেশগুলোর সম্পর্কে আপনার ধারণা বদলে দেবে দুবাই। তবে সবথেকে চমৎকার আবহাওয়া পাবেন আপনি ডেজার্ট সাফারি ভ্রমনের সময়। আপনি মরুভূমিতে থাকবেন কিন্তু মনে হবে চিরবসন্তের কোনো দেশে অবস্থান করছেন। মৃদুমন্দ বাতাস আর তার সাথে আরবীয় আবহাওয়া সে যেন এক দারুণ অনুভূতি। চলুন ডেজার্ট সাফারি ভ্রমনের মূল আকর্ষণ সমূহের সাথে একটি এডভেঞ্চার হয়ে যাক।
১. ডুন ব্যাশিং
ডেজার্ট সাফারি ভ্রমনের মূল আকর্ষণ হলো ডুন ব্যাশিং। মরুভূমির উঁচু নিচু বালুকাময় ভূমিতে জিপে করে ঘুরে বেড়ানোকে মূলত ডুন ব্যাশিং বলে। ডেজার্ট এর পুরো ভুৃমি জুড়েই উঁচু টিলা আর বালুর স্তুপ। এর মধ্যে দিয়ে জিপ ছুটে চলে ঝড়ের গতিতে। কখনও মনে হয় গাড়িটি কাত হয়ে পড়ে যাবে আবার কখনও মনে হয় এই বুঝি গাড়ি উল্টে পড়ে গেল। এক হাড় কাঁপানো রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আপনাকে ডুবিয়ে রাখবে ঘন্টাখানেক সময়ের মতো। রোলার কোস্টারের থেকেও বেশি ভয়ানক এডভেঞ্চার এই ডুন ব্যাশিং। তবে ভয়ের কোনো কারণ নেই, ডুন ব্যাশিং এর ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটেছে এমন খুব কমই শোনা গেছে। কেননা ডেজার্ট সাফারিতে চলমান জিপের প্রতিটি ড্রাইভার অনেক বেশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। তাই তারা দক্ষতার সাথে নিরাপদে আপনার ভ্রমণ সম্পন্ন করবে। আর প্রত্যেক ড্রাইভারের আছে ডেজার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স। তাই ডেজার্ট সাফারি ভ্রমণে ডুন ব্যাশিং মিস করতে চান না কেউ। তবে হার্টের সমস্যা থাকলে বা মানসিক ভাবে দূর্বল হলে ভ্রমণ প্লান থেকে ডুন ব্যাশিং বাদ দেওয়াই ভালো।
২. কোয়াড বাইক
কোয়াড বাইক হলো মরুভূমির বুকে চলমান চার চাকার মোটরবাইক। আপনি চাইলে বিশ থেকে ত্রিশ মিনিটের জন্য কোয়াড বাইক ভাড়া নিয়ে মরুভূমির বুকে চালাতে পারবেন। কোয়াড বাইক গুলো এমন ভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে অনভিজ্ঞ কেউ প্রথমবারেই এটি চালাতে পারবে। সিঙ্গেল অথবা ডবল দুই ধরনের কোয়াড বাইক পেয়ে যাবেন ডেজার্ট সাফারিতে। কোয়াড বাইকিং এর সময় আপনি মরুভূমির মুক্ত পরিবেশে ঘুরে বেড়ানোর এক দারুণ অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন। সেই সাথে বালুতে গোসল করার মতো অবস্থাও অবশ্য হবে।
৩. স্যান্ড বোর্টিং
বালুতে বোট নিয়ে ডাইভিং করার স্বপ্ন কমবেশি সবারই আছে। আপনি চাইলে স্লিপার বোট ভাড়া নিয়ে মরুভূমির বালুতে ডাইভিং করতে পারবেন। এভাবে বালুর খাদে খাদে ভেসে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা মিস করা একদম বোকামি হবে। আপনার ডাইভিং দক্ষতা যাচাই করার একটা বাস্তব সুযোগ হবে এখানে।
৪. স্কাই ডাইভিং
ডেজার্ট সাফারি ভ্রমনে গিয়ে স্কাই ডাইভিং এর চেষ্টা চলে সবারই। তবে এটি যেমন খরচ সাপেক্ষ তেমন আবার সিরিয়াল পাওয়াটাও একটু কষ্টকর। আপনি যেদিন স্কাই ডাইভিং করতে চান তার তিন চার দিন আগেই অনলাইনে বুকিং দিয়ে রাখতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হতে হবে স্কাই ডাইভিং এর জন্য নির্ধারিত পয়েন্টে। তবে স্কাই ডাইভিং এর সুযোগ পেলে এটাই হবে দুবাইয়ে আপনার সবথেকে বেশি উপভোগ্য অভিজ্ঞতা। পাখির চোখে পুরো দুবাই শহরকে এক্সপ্লোর করতে পারবেন প্যারাসুট এর ওপর থেকে।
৫. ক্যাম্পিং
ডেজার্ট সাফারি ভ্রমনের মূল উদ্যেশ্যই থাকে মরুভূমির বুকে ক্যাম্পিং করা। ডুন ব্যাশিং এর মাধ্যমে আপনার গাইড আপনাকে নিয়ে যাবে মরুভূমির মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত কোনো এক রিসোর্টে। সেখানে তাবু খাঁটিয়ে রাত কাটাতে পারবেন। মরুভূমির বুকে তাবু খাঁটিয়ে ক্যাম্পিং করার সৌভাগ্য খুব কম মানুষেরই হয়। সারারাত চলবে আরবীয় ঐতিহ্যের বিনোদন, খাওয়াদাওয়া আর হুল্লোর। নিজেকে তখন আরবের বাদশাহ বলে ভাবলেও দোষের কিছু নেই।
৬. আরবের ঐতিহ্যবাহী খাবার ও আরবি কফি
আপনি যে রিসোর্টে ক্যাম্পিং করবেন সেখানে সারারাত জুড়েই থাকবে নানান ধরনের খাবারের আয়োজন। একদিকে ফ্রেশ ফল ও বিভিন্ন স্ন্যাকস আইটেম ফ্রী তে চলতে থাকবে। আর থাকবে ব্যুফে ডিনার। ডিনারে চেখে দেখতে পারবেন আরবের বিখ্যাত সব খাবার। আরবের কাবাব, খবুজ, কোফতা, মানসাফ সহ বিভিন্ন এরাবিয়ান খাবারের অথেনটিক স্বাদ পাবেন ব্যুফে আইটেম এর মধ্যে। আর বিখ্যাত আরবি কফি না খেলে তো বিশাল বড় লস করে ফেলবেন। শীশা নামক একটি ধূমপান-ও ট্রাই করে দেখতে পারেন। সব মিলিয়ে সারারাত জুড়ে খাবারের কোনো কমতি হবে না।
৭. বেলি ড্যান্স ও তানুরা নাচ
বিনোদন ও আনন্দ উল্লাসেরও যেন কমতি নেই ক্যাম্পিং এর মধ্যে। সারা রাত মুক্ত মঞ্চে চলতে থাকবে আরব সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী বেলি ড্যান্স ও তানুরা নাচ। নর্তকীর নাচের ঝলকে মন যেন হাওয়ায় ভাসতে থাকবে। সেই সাথে একটু পরে পরেই পরিবেশন করা হবে বিভিন্ন প্রকার ড্রিংস। বিনোদনের এই তো শেষ না, আরও থাকবে হৃদয় কাঁপানো সার্কাস শো। বিভিন্ন অবাস্তব কর্মকাণ্ড দেখিয়ে আপনাকে চমকে দেবে এরাবিয়ান সার্কাস এক্সপার্ট। এই আনন্দঘন বিনোদনের মধ্যে দিয়ে রাত যে কখন ফুরিয়ে যাবে তা আপনি টেরই পাবেন না।
৮. হেনা আর্ট
এরাবিয়ান ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে মেহেদি আর্ট এর সংস্কার। তাইতো ডেজার্ট সাফারি ভ্রমনের সময় মহিলাদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে এই হেনা আর্ট। প্রফেশনাল অভিজ্ঞ মেহেদী আর্টিষ্টদের কাছ থেকে দু-হাত রাঙিয়ে নিতে ভুলেন না যুবতীরা। চাইলে আপনি-ও এরাবিয়ান স্টাইলে হেনা আর্ট করিয়ে নিতে পারবেন ডেজার্ট সাফারি এসে।
৯. উটের পিঠে চড়া
ডেজার্ট সাফারি ঘুরতে ঘুরতে প্রায়ই আপনার চোখের সামনে পড়বে উটের পাল। মরুভূমিতে ঘুরবেন আর উটের পিঠে চড়বেন না এ আবার হয় নাকি। সময় চুক্তিতে নির্দিষ্ট অর্থ খরচ করে আপনি উটের পিঠে করে মরুভূমির বুকে ঘুরে বেড়াতে পারবেন। আপনার রিসোর্ট এর আশেপাশেই এমন অনেক উট ও ঘোড়া পেয়ে যাবেন।
১০. ফটোসেশান
চাইলে ড্রাইভারকে আপনার ক্যামেরাম্যান বানিয়ে নিতে পারেন। যেহেতু জিপের ড্রাইভার আপনার ট্যুর গাইড, তাই আপনার ভ্রমণকে পুরোপুরি আনন্দঘন করার দায়িত্ব তার। তাই ড্রাইভারের সাহায্যে মরুভূমির যে কোনো ভিউ থেকে ফটোসেশান করে নিন। আরবের পুরুষের স্থানীয় পোশাক ভাড়া নিয়ে আপনিও সাজতে পারবেন আরবের বাসিন্দাদের মতো। এই লুকে ফটোসেশান না করলে চলে নাকি? জিপের ওপরে বসে, উটের পিঠে, বাইক রাইডিং এর সময় প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে অবশ্যই ক্যামেরাবন্দী করে নিয়ে আসবেন।
১১. সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য
মরুর বুকে যখন সূর্য ওঠে তখন লাল আভায় বালু গুলো চকচকে সোনার মতো মনে হয়। এই দৃশ্য আপনাকে ভুলিয়ে নিয়ে যাবে অজানা এক জগতে। আবার সূর্যাস্তের দৃশ্যও ঠিক একই রকম অনুভূতি দেবে আপনাকে। বালুর নিচে টুপ করে সূর্যটি হারিয়ে যাবে আর দিগন্তের রাঙা প্রভা ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। অনেকেই শুধুমাত্র সূর্যোদয় দেখার জন্য খুব ভোরে ডেজার্ট সাফারি ভ্রমনের প্লান করেন।
শেষকথা
আশাকরি ইতোমধ্যে ডেজার্ট সাফারি ভ্রমন সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পেয়ে গেছেন। হয়তো কল্পনায় ঘুরে এসেছেন দুবাই এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থেকে। আমার মতে দুবাই ভ্রমণে অবশ্যই ডেজার্ট সাফারিকে সবার আগে প্রাধান্য দেয়া উচিত। আপনার জন্য একটি সুন্দর ও সুপরিকল্পিত ভ্রমণের শুভেচ্ছা রইলো। ধন্যবাদ।
দুবাই এর আরও কিছু দর্শনীয় স্থান:
- বুর্জ খলিফা
- বুর্জ আল আরব
- পাম জুমেইরাহ
- দুবাই অ্যাকোয়ারিয়াম
- আটলান্টিস অ্যাকোয়াভেঞ্চার
- স্কি দুবাই
- দুবাই মেরিনা
- দুবাই ফ্রেম
- মিরাকল গার্ডেন
- ডলফিনারিয়াম